ধ্বংসাবশেষে সৃষ্টির রূপকথা


পারভেজ আলম

সামগ্রিক কাজ https://sarkerprotick.com/Of-River-and-Lost-Lands




সরকার প্রতীকের ফটোগ্রাফির এই প্রদর্শনীটা আমস্টার্ডামে হইছিল গত বছর। তখন থেকেই ভাবছিলাম এই প্রদর্শনীটা ও প্রতীকের ছবি নিয়া কিছু লিখবো। তবে ঐ সময় মদিনা বইটা এবং ক্লাস নিয়ে ব্যস্ততার কারনে তা আর করা হয় নাই। আজকে এই করোনা ক্রাইসিসের সময় তার ছবিগুলা আমার কাছে আরো প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। প্রতীকের ছবিগুলার একটা বৈশিষ্ট্য হলো, যদিও সে আমাদের বাংলাদেশের ছবিই তোলে, আমাদের বর্তমান বাস্তবতার ছবিই তোলে, কিন্তু সে যে দুনিয়াটা হাজির করে তা অন্য একটা দুনিয়াও। তার ছবি দেখতে গেলে আমার একেবারেই প্রাথমিক যে অনুভুতিটা হয়, তা অনেকটা একটা ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড দেখার মতো। ফ্যান্টাসি ফিকশন লেখকেরা যেমন ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং-এ সিদ্ধহস্ত, প্রতীকও ফটোগ্রাফার হিসাবে তেমনি। বাংলাদেশের ছবি তুলতে তুলতেই সে একটা আলাদা ওয়ার্ল্ড বানায়। যেই প্রদর্শনির কথা বলছি তা এই ওয়ার্ল্ড বিল্ডিং-এর এফেক্টটা হাজির করে খুব ভালোভাবেই। এই দুনিয়া মেলানকোলিক, কিন্তু তাতে উৎসব আছে, আছে অনন্ত সম্ভাবনা।




এই প্রদর্শনীটার নাম ছিল 'অফ রিভার এন্ড লস্ট ল্যান্ডস'। বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের নদী ভাঙন কবলিত গ্রামের ছবি (ঈশ্বরদী)। কিন্তু কাজগুলো একটা আলাদা দুনিয়াও হাজির করে, এবং একটা আলাদা সময়ও। তা একিসাথে তুলে ধরে এই দুনিয়ায় মানব জাতির অস্তিত্বগত কিছু ইউনিভার্সাল সত্যও। এবং প্রতীক আমাদের বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ অস্তিত্বগত সত্যকে উদাহরণ হিসাবে নিয়ে তার ইউনিভার্সাল শিল্প গড়ে তোলার কারনেই, তা আমাদের জন্যে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। এই প্রদর্শনীর ছবিগুলা সবচাইতে বেশি যা তুলে ধরে তা হইল ধ্বংসাবশেষ। এই ধ্বংসাবশেষ শুধু নদী ভাঙনের শিকার হওয়া ঘরবাড়ি, বা আমাদের প্রতিবেশ না। প্রতীক আমাদের প্রতিবেশের ধ্বংসাবশেষকে আলাদা করে দেখান না, তার ফটোগ্রাফিতে বরং নদীর জলে বিলীন হতে থাকা গাছ, শুয়ে থাকা মহিষ, আর ডুবতে থাকা মানুষের বাড়ি; মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের প্রতিনিয়ত ধ্বংসের মুখোমুখি হওয়াটাকে প্রতীক একটা অবিচ্ছেদ্য ধ্বংসের কাহিনি হিসাবেই হাজির করেন। আর মানুষ, এই কাহিনির সবচাইতে সুন্দর ও রহস্যময় চরিত্র। প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাদেরকে যুদ্ধ করতে দেখা যায় না। তারাও প্রকৃতির মতোই ভাঙেন, এবং গড়েন, উৎসব করেন। তাদের বলিষ্ঠ পেশীর মধ্যে হাজির হয় প্রকৃতিরই অনন্ত সম্ভাবনা। এইদিক থেকে প্রতীকের ছবির মধ্যে এস এম সুলতানের পেইন্টিং-এর মতোই একধরণের ভাইটালিটির দার্শনিকতা হাজির থাকতে দেখা যায়। সুলতানের পেইন্টিইং-এ হাজির থাকা অত্যাধিক পেশীগুলাকে আপনি ভাইটালিটি বা সম্ভাবনার উপস্থাপন ছাড়া অন্য কিছু ভাবলে ভুল করবেন, কারন বাস্তব মানুষের পেশী অমন হয় না। কিন্তু প্রতীকতো পেইন্টার না, সে ছবি তোলে, সে মুহূর্তকে ধরে রাখে বাস্তবতার সবচাইতে কাছাকাছিভাবেই। ফটোগ্রাফির এ এক সীমাবদ্ধতা, কিন্তু তা আবার সম্ভাবনাও, যদি কেউ বড় ফটোগ্রাফার হয়ে থাকে। প্রতীক বড় ফটোগ্রাফার, তার ছবিতে সে সম্ভাবনাকে ধরে রাখতে পারে – কৃষকের পেশীতে, হাতুরিতে, ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলপড়ুয়া বালকের মধ্যে, প্রায় ধূসর হয়ে যাওয়া ক্ষেতের মাঝে কিশোরীর চাহনিতে, কচুপাতার উপর টপ্টপ করে পড়া পানির মধ্যে। এই ছবিগুলার যে দুনিয়া, সেই দুনিয়ায় ধ্বংসাবশেষের মধ্যে যে মানুষেরা থাকে, তাদের কাহিনি দুঃখ দুর্দশায় জর্জরিত মৃত্যু ও ধ্বংসের নয়। বরং তাদের কাহিনি প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশের এক অবিচ্ছেদের কাহিনি, যেখানে মানুষের বসবাস সদা পুনরুত্থানের মধ্যে। ধ্বংসাবশেষগুলাই এই কাহিনিতে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়।



সরকার প্রতীক ইতিমধ্যেই একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার। তবে বাংলাদেশে শিল্পী হিসাবে হয়তো নিজ ভুবনের বাইরে অতোটা পরিচিত নয়। এই করোনা ক্রাইসিস আর মেলানকোলিয়ার মুখোমুখি যখন বাংলাদেশের মানুষ; তখন অন্য ভুবন আর অনন্ত সম্ভাবনার কাহিনীকার প্রতীকের এই প্রদর্শনীটা নিয়ে লিখে ফেলতে ইচ্ছা হইল।

অ্যামস্টারডাম
মার্চ, ২০২০









COPYRIGHT© 2024 SARKER PROTICK